অনুগল্প
অপার্থিব হুইসেল।
___________________
.
রাত একটা বেজে সতের মিনিট। কমলাপুর স্টেশানের ওভার ব্রিজ টার উপর দাড়িয়ে আছে শাওন। এই তো মিনিট খানেক হলো রংপুর এর উদ্দেশ্যে লোকাল ট্রেনটা ছেড়ে গেল।বাকি আছে আরও দুইটা ট্রেন। শেষ ট্রেন টা ছেড়ে যাওয়ার কথা এখন থেকে ঠিক আড়াই ঘন্টা পর।
আজ আবহাওয়া টা একটু বেশি ঠান্ডা, সাথে ভয়ংকর রকমের বাতাস। পকেটের শেষ সিগারেট টা বের করে ধরাতে লাগলো শাওন। ব্যান্সনের দুমড়ে মুচড়ে থাকা একটা প্যাকেট… ভিতরে একটা কম দামের সিগারেট স্মোকিংটা সে শুরু করেছিল ব্যান্সন দিয়েই, ছোট থেকেই বেশ সৌখিন মানুষ ছিলো।
কিন্তু বড় হবার সাথে সাথে সেই সৌখিনাগুলোকে পালন করবার মত আর্থিক যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে, তাই দোকান থেকে কমদামী সিগাররেট নিলেও সেটাকে ব্যান্সনের প্যাকেটেই দিতে বলে। সিগারেট টা ধরাতে পরপর দুবার মিস হলো। হেসে উঠলো শাওন,, এই শেষ সিগারেট টাও যেন তামাশা শুরু করেছে তার সাথে।
অবশ্য তামাশার সূত্রপাত যে সিগারেট থেকেই শুরু হয়েছে তা কিন্তু মোটেও না।
আচ্ছা মূল কথায় আসি,,,,
গ্রামের হত দরিদ্র বাবা মায়ের সন্তান শাওন।।
দীনবন্ধু কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে সেকেন্ড ক্লাস অনার্স পাশ করে। কমলাপুর স্টেশানের পাশে একটা মেসে থাকে।।
কয়েকটা টিউশানি করে দিন চলে।আর এই টিউশনির অভিশাপেই খারাপ হয় তার রেজাল্ট। নিজের সামান্য কিছু রেখে বাকি টাকাটা পাঠিয়ে দেই গ্রামে।
চাকরি খুজতে খুজতে যতগুলা চটি জুতা যে তার ক্ষয় হয়েছে তার হিসেব করতেই ভয় লাগে । তাই চাকরির আশা পুরোটাই ছেড়ে দিয়েছে।
এদিকে ছোট বোনটা টার বিয়ের প্রস্তাব আসছে। আর যৌতুকের অংক টাও নেহাত কম না।
সবচেয়ে বড় কথা হলো,,
বাবা মা জানে শাওন রেলে চাকরি করে। সরকারি চাকরি। মিথ্যাটা শাওন নিজেই বলেছে, কেননা চার বছর ধরে অনার্স পাশ করা লাগে জানলে কখনো হয়ত শহরে তাকে আসতেই দিতো না।
আর শহরে না আসলে তার অনেক চাওয়াই অপ্রাপ্তির খাতায় নাম লেখাত । আর কেনো জানি তার উপর দিন কি দিন এক্সপেকটেশন টা বেড়েই চলছিল তার বাবা মায়ের
,,এতে কোন তাদের দোষ নাই, এর জন্য রেলে চাকরির মিথ্যাটায় দায়ী।
.
আর সাদিয়া তার জীবন থেকে গেছে সেতো বছর খানেক হলো। পরিচয় হয়েছিল একট রক্তদান শিবির থেকে।
অবশ্য সাদিয়া কে দেওয়ার মত কিচ্ছুই ছিল না শাওনের,, আর সাদিয়ার ব্যাপারে সে কখনো আফসোস করেনা। ভালবাসা দিয়ে হয়ত মনের ক্ষুধা মেটানো যায় পেটের না।
শাওন যে মধ্যবিত্ত টাইপের গরীব এটা সাদিয়া বুঝত, কিন্তু কেনো জানি মেনে নিতে পারত না।
দিনশেষে সাদিয়া যখন পিজ্জা টা তৃপ্তির সাথে খেত , কখনো বুঝেনি সেটা শাওনের দু বেলার খাবার খরচ থেকে বাচানো টাকারই ভগ্নাংশ। অবশ্য সেই তৃপ্তি টুকু দেখেই শাওনের সারা দিনের ক্ষুধারা স্বেচ্ছায় চলে যেত।
আর ব্রেক আপের পিছনে শাওনের ই অবদান বেশি। স্বাধীন স্বপ্ন পিপাসু সাদিয়াকে তার ছোটলোকির মধ্যবিত্ত জীবনে জড়িয়ে কখনো পরাধীন করতে চায়নি সে।
"আর মিনিট পাচেক বাকি।
শেষ ট্রেন টার হুইসেল যদিও এখনো বাজেনি , তবে প্রস্তুতি নিচ্ছে কম বয়েসি স্টেশান মাষ্টার টা। সম্ভবত নতুন জয়েন করেছে … হেসে উঠল শাওন, ভাবল নতুন জয়েন করার কারণেই হয়ত বেশ দায়িত্ত্ব সচেতন। কিন্তু পরক্ষনেই তার হাসিটা উবে গেল … সে চিন্তা করল যে তার বাবা মা ও তাকে এমন একটা স্টেশান মাষ্টারের পোশাকে কল্পনা করেই দিনের শেষে ঘুমোতে যায়।
.
হ্যা, কিছুক্ষন পর সত্যিই হুইসেল শোনা গেল। বহু দূর থেকে একটা শব্দ বাতাসের সাথে মিলিয়ে আসছে … শব্দটাকে আজ কেন জানি অপার্থিব মনে হচ্ছে শাওনের,,, অন্য দিন কার মত নয়। কমলাপুর স্টেশানে আসা সব ট্রেনের হুইসেল শুনতে পায় সে ঘরে বসেই …কিন্তু আজকের হুইসেল্টা কেমন যেন একটা অলৌকিক উপহাস মেশানো ছিল তাতে …যেন শাওনের হেরে যাওয়াকে বিদ্রুপাত্তক আলিংগন করতে এগিয়ে আসছে ট্রেনটি। শাওন জানত এই ট্রেনটা রংপুর এর উদ্দেশ্যে রওনা করেছে। কিন্তু এত রাতে শাওন স্টেশানে কেন ??????
আসলে এটাকে আত্মহত্যা বলে কিনা ঠিক জানেনা শাওন।। তার সামান্য জ্ঞানে আত্মহত্যা বলতে যা বুঝায় সেটা হল মৃত্যুর মুখে নিজে ঝাপ দেওয়া।
কিন্তু পরিস্থিতি যখন জ্বলোজ্যান্ত রক্তমাংসের শরীরকে একটা অপার্থিব জগতের দিকে ঠেলে দেয় তখন সেটাকে কি বলে ???
আচ্ছা … এই কয়টা কারন কি নিজের জীবন নিজে শেষ করে দেবার জন্য যথেষ্ঠ,,,,,,??
– প্রশ্ন করল শাওন নিজেকে। পরক্ষনেই কিছু মুখ ভেসে আসল তার সামনে- প্রথমটি তার মায়ের, যিনি জানতেন শাওন রেলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। প্রায়শই ছেলেকে প্রোমোশানের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতেন তিনি। দ্বিতীয় জন তার বাবা … যিনি কখনো জীবনে আপোষ করেননি মিথ্যার সাথে, আজ অনেকটা পংগুর মত পড়ে আছেন বিছানায়,
তাকে কি জবাব দিবে শাওন,,?
বোনটাকেই বা কি বলে স্বান্তনা দিবে সে ? সাদিয়ার মুখটা ভেসে আসতে চেয়েছিল তার মনে, কিছু তক্ষুনিই দ্বিতীয় ও শেষ হুইসেল্টা শোনা গেল। বেশি ভাবতে চায়না শাওন, কেননা লাফ দিতে একটু দেরি হলেই সে ট্রেনের নিচে না পড়ে ছাদের উপর পড়বে। তখন হাসপাতালে পুলিশের জেরা সামলাতে হলে আরেক কেলেংকারী।
.
পরদিন সকালে পুলিশ একটা মৃতদেহ উদ্ধার করে, রেললাইনের উপর। দেহটা পাজর বরাবর কেটে টুকরো হয়ে গেছে। মাথাটা অক্ষত আছে… চেহারাটা বোঝা যায়। ম্যানিব্যাগ থেকে দুটো চিঠি উদ্ধার করে।
প্রথমটি বাংলায় ও দ্বিতীয়টি ইংরেজি তে লেখা। ওসি সাহেব অবশ্য ভিমড়ি খেয়েছিলেন এত সুন্দর হাতের লেখা দেখে।
চিঠির প্রথমটাতে তার এক চোখ আর কিডনি বিক্রির টাকার কথা ও তার ব্যাংক হিসেব নং লেখা।
এবং সে এই টাকাটা তার পরিবারের জন্য দিয়ে গেছে।
আর তার শেষ ইচ্ছা ছিল তার মিথ্যা চাকরির কথাটা পরিবার কে যেন না জানানো হয়।।
এটা অর্গান ডোনেশানের টাকা। আর দ্বিতীয় চিঠিটার কোন মাথা মুন্ডু বোঝেনি ওসি সাহেব। এত হাই লেভেলের ইংরেজি বিদ্যা পাঠের মত নলেজ ছিল না মোটেও ব্যাচারার। বহু কষ্টে কিছু শব্দ কোন মতে বুঝতে পারলেন তিনি,,,,,,, সেগুলো : " Sadiya,, Circumstances,, forced … Take Care...love you..
এভাবেই পরিস্হিতির কারনে অকালে ঝরে গেল একটি তাজা প্রান,,সেই সাথে ভেঙে মিসমার হয়ে গেল কয়েটি মানুষের আশা,,ভরসা।।
.
বিঃদ্র- আত্মহত্যা খুব জঘন্য অপরাধ। কারন আত্মহত্যা করলে মানুষ মরে যায়।ফলে এতে কোন স্বার্থকতা থাকে না,,, তাই বরং আসুন… যুদ্ধ করে বাচতে শিখি। মানুষ হিসেবে জন্মানোর স্বার্থকতা টুকু ওখানেই নিহিত।
লেখা:--Shamim AL Hasan Sawon


|
|★★★

মন্তব্যসমূহ