মাহদী জিদান এর লেখা নতুন গল্প #সংসোধন

গল্প - সংসোধন 

লেখক - মাহদী জিদান


.
এখন বুঝতে পারছি বিষয়গুলো কেমন লাগে। অনেকগুলো ছেলে রাস্তায় আড্ডা দেওয়ার সময় একটা মেয়েকে যখন হেঁটে যেতে দেখে তখন তাদের কূটক্তিগুলো মেয়েটার কাছে কেমন লাগে তা আমাদের এই সমাজের মানুষগুলোর যতক্ষণ না নিজের ঘাড়ে এসে ভীড়ে, ততোক্ষণ পর্যন্ত তাদের বোধে আসে না। তবুও বলতে হয়, আমরা সুশীল সমাজ। যেখানে একটা মেয়ে আর একটা ছেলেকে একসাথে হাঁটতে দেখলে তাদের সংকীর্নমনে এক মুহূর্ত দেরী লাগে না ঋণাত্মক চিন্তাধারা আসার। কেন?  হতে পারে তারা ভাই-বোন, তারা ক্লাসমেট নতুবা শুধুমাত্র ফ্রেন্ড। একটা মেয়ে আর একটা ছেলে একসাথে ঘুরতে বের হলে বা হাঁটতে বের হলেইই যেযে তারা প্রেমিক-প্রেমিকা এমন চিন্তাধারা বোধহয় কিছু লোকের মাথায় জন্মগত ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিজের বোনের সাথে বের হয়ে অনেকবারই এর প্রমাণ পেয়েছি বন্ধুমহল আর এলাকার মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গী দেখে।
একটা সময় ছিলো,  যখন আমি আমার বোনকে নিয়ে বের হতে চেতাম না।কিন্তু এখন বের হই , ঘুরতে যাই একসাথে।কারণ এ ধরনের মানুষের চিন্তাধারায় আমার কিছু যায় আসে না এখন।তাই, এ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো ইচ্ছেও নেই। কিন্তু কিছু মানুষের বিকৃত মস্তিষ্কের কূটক্তি ও চিন্তাধারা হয়তো কখনোই সম্পূর্ণরূপে  মুছে ফেলা যাবে না এই সমাজ থেকে। 
আবার এমনও না যে আমি এর ব্যতিক্রমী।বন্ধুমহলে একসাথে বসে এমন মুহূর্তগুলোতে বাধা দিতে দিতে সময়ের তালে নিজেও তাদের সাথে মিশে গেছি অনেকবার। যারই ফলস্বরূপ কিছু ধাক্কা পেয়েছি জীবনে যা হয়তো আজ বদলাতে সাহায্য করছে।
একটা ঘটনা বলি, ঘটনাটি সম্পূর্ণই  কল্পনার আঙ্গিকে সৃষ্ট।  একটা ছেলে আর একটা মেয়ে খুব ভালো বন্ধু ছিলো। এক সময় ছেলেটা মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলে।  মেয়েটাও ছেলেটাকে পছন্দ করতো, তবে ফ্রেন্ড হিসেবে। তাই,ছেলেটাও ফ্রেন্ড হিসেবেই ছিলো।তাদের এফবিতে কথা হতো। মাঝে মাঝে দেখা হতো তাদের দুজনের বাসা কাছাকাছি হওয়াতে।কিন্তু কখনো সরাসরি কথা বলতো না।একদিন কিভাবে যেন ছেলেটার মেয়েটাকে পছন্দ করার কথা বন্ধুমহলে ছড়িয়ে পরে। যার ফলস্বরূপ, মেয়েটা যখনই ঘর থেকে বের হতো কোথাও যাওয়ার উদ্দেশ্যে ছেলেটার বন্ধুমহলের ছেলেগুলো মেয়েটার দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকানো শুরু করে, তার পিছন পিছন অনেক ধরনের অনর্থক কথা বলে । হঠাৎ এমন পরিস্থিতি মেয়েটাকে খুব কষ্ট দেয়। সে বুঝতে পারছিলো না কেন তারা এরকমভাবে তাকায়। যখন বুঝতে পারে যে ছেলেটা তাকে পছন্দ করে এবং  এই জন্য ছেলেটার বন্ধুমহলের ছেলেরা তার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকায় তখন মেয়েটা খুবই কষ্ট পায়। মেয়েটা চুপ থাকে,  ছেলেটাকে কিচ্ছু বলে নি। কিন্তু কয়দিন!! মেয়েটার পরিবার একসময় সেখান থেকে বাসা ছেড়ে অনেক দূরে চলে যায়।এফবিতে কথা বলার সুযোগ থাকলেও মেয়েটা কথা বলা কমিয়ে দেয় ছেলেটার সাথে। কোনো মেসেজের রিপ্লাই দেয় না ঠিকমত। বিরক্ত অনুভব করে মেয়েটা ছেলেটার উপর। একদিন বিরক্তির এমন পর্যায়ে যায় যে মেয়েটা বলেই বসে ছেলেটাকে যে, "তোমাদের ছেলেদের জন্যই আমারা মেয়েরা রাস্তায় শান্তিমত হাঁটতে পারি নাহ,মানুষের কুদৃষ্টিরর মুখে পড়তে হয় প্রতিনিয়ত। এমনও কথা শুনতে হয় যা শুনার মতো না। তারপরও সবসময় আমাদের মেয়েদেরই দোষ দেওয়া হয়। সবকিছু আমাদেরই দোষ। " ছেলেটা অনেক বুঝিয়েও শেষ পর্যন্ত তার বন্ধুত্বটুকুও টিকিয়ে রাখতে পারলো না। তারা এখন শুধু এফবিতে দুটি সবুজ বাতি। কেউ কারো মেসেজের রিপ্লাই দেয় না।
এই কাল্পনিক ঘটনাটি হলো অতি সাধারণ ক্ষুদ্র একটি উদাহরণ আমাদের সমাজের কিছু মানুষের কর্মকান্ডের।এখানে শুধুমাত্র দুটি মানুষের বন্ধুত্ব ভাঙ্গনের দৃশ্য ফুটে উঠেছে। এর আরো ভালো বাস্তব উদাহরণ আমরা নিত্যনৈমিত্তিক বিভিন্ন পত্রিকায় পেয়ে আসছি প্রতিদিন। অনেক ঘটনাতো প্রকাশও হয় না।  এর আগেই ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়। একটি মেয়ের মানসিক যন্ত্রণার উদাহরণের মধ্যে এটিও হয়তো রয়েছে।
আমার এই লেখার মাধ্যমে অনেকে হয়তো ভাবছেন, "আসছে জ্ঞান দিতে। মেয়েদের সিম্প্যাথি পাওয়ার জন্য পোস্ট দিয়েছে। "
ভাই, ক্ষমা করবেন কারো সিম্প্যাথি পাওয়ার আমার কোনো দরকার নেই, ইচ্ছাও নেই। নিজের মাঝেই বাঁচি আমি। এই লেখাটা শুধু মাত্র নিজের কিছু ভুলের কথা মনে করে লিখেছি। যদি সিম্প্যাথি পাওয়ারই ইচ্ছা থাকতো তাহলে আরো আগেই লিখে পোস্ট দিতাম নারী দিবস উপলক্ষে। কিন্তু আমি এইসব দিবসে বিশ্বাসী না এবং পালনও করি না। মা দিবস, বাবা দিবস, ভালোবাসা দিবস, নারী দিবস ইত্যাদি সব দিবসে আমি কখনো কোনো লেখা লিখি না। কারণ,  এই দিবসগুলোতেই মানুষের আবেগ হঠাত কোথা থেকে জেগে ওঠে।  সারা বছর যার খবর থাকে না তারও এইসব দিবসে অতিমাত্রায় আবেগ জেগে ওঠে। তাই আমি শুধুমাত্র দেশের জাতীয় দিবসগুলো অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধগত দিবসগুলো ছাড়া আর কোনো দিবসই পালন করি না। এটা আমার নিজস্ব মতামত মাত্র। কারো খারাপ লেগে থাকলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। 

আর একটা ঘটনা বলি যেটা বাস্তবিক। ছোট থাকতে আমার নানী আমাকে তাদের এলাকায় বহুদিন আগে ঘটা একটি চুরির কাহিনী বলেন। একদিন রাতে সেই এলাকায় একটি বাড়ীতে চুরির ঘটনা ঘটে। গভীর রাতে চোরগুলোর চুরি করার সময় বাড়ির একলোক তাদের দেখে ফেলে। লোকটি দেখামাত্রই যখন চোর চোর বলে চিৎকার শুরু করলো চোরগুলো ধরা পাওয়ার ভয়ে তৎক্ষণাত পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে মানুষের চিৎকার চেচামেচিতে পুরো বাড়ীর মানুষ জেগে যায় এবং সবাই চোর চোর বলে লাঠিসোটা  নিয়ে এদিক সেদিক খুজতে থাকে।তাই তারা পালাতে পারে নি।ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। শেষর পর্যন্ত চোরগুলো পালাবার উপায় না দেখে নিজেদের বাঁচানোর জন্য ভয়ে তারাও চোর চোর বলে বেরিয়ে এসে চোর খোজার অভিনয় শুরু করে। বাড়ীর মানুষদের সাথে তাল মিলিয়ে তারাও যোগ দেয় চোরখোজায়। কিন্তু বাড়ীর মানুষ তাদের চিনে ফেলে কারণ তারা সেই বাড়ীর লোক ছিল না।  অতঃপর গাছের সাথে বেঁধে তাদের বেদম মাইর দেওয়া হয় এবং সারারাত তাদের সেখানেই বেঁধে রাখা হয়।ওইদিন আমি নানীর মুখে গল্পটা শুনে সত্যি অনেক হেঁসেছিলাম।
একইরকম আরো বেশি হাস্যকর ঘটনা আমি আমাদের এলাকারই কিছু মানুষদের কর্মকান্ড দ্বারা দেখেছি।এবার নারী দিবসের চারদিন আগের ঘটনা। বিকেলের দিকে আমি আমার এক আত্মিয়ের বাসায় যাচ্ছিলাম একটি প্রয়োজনীয় কাজে।  যাওয়ার সময় এলাকার একটি পুলের ওপর একটা ছেলেকে তার বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিতে দেখি। ছেলেটাকে আমি চিনি। আমি না শুধু, বলতে গেলে প্রায় সবাই চিনে।এলাকায় মোটামুটি ছ্যাঁচড়া হিসেবে ভালোই নামকরা। তখন আমার সামনে দিয়ে একটা মেয়ে হেঁটে আসছিলো। বোরকা পরা, কাঁধে ব্যাগ।  হয়তো স্কুল থেকে আসছিলো নয়তোবা প্রাইভেট পড়তে যাচ্ছিল। ছেলেগুলো মেয়েটাকে দেখে শিস বাজানো থেকে শুরু করে আরো অনেক অনর্থক কিছু কথা বলাও শুরু করেছিল।  মেয়েটা একবারও তাকায়নি তাদের দিকে।হেঁটে চলে যাচ্ছিলো শুধু মাথা নিচু করে।
  সেদিন আমি মেয়েটার মাঝে ড্রেস আপের কোনো দোষ দেখিনি। সুন্দর মতো বোরকা পরে মুখ বেধে রেখেছিল মেয়েটা।তবুও মেয়েটাকে এমন ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। সেদিন ছিল  আরেকটি দিন যেদিন আমি বুঝতে পারি মেয়েদের কাছে কেমন লাগে এরকম পরিস্থিতিতে। না পারে প্রতিবাদ করতে আর না পারে সহ্য করতে।
মজার বিষয় কি জানেন? এই ছেলেটাই কিন্তু পরবর্তীতে নারী দিবস উপলক্ষে এফবিতে কোনো এক জনপ্রিয় গ্রুপে একটা ছোটখাটো পাঁচ লাইনের আর্টিকেল লিখেছিলো নারীদের সম্মান-মর্যাদা নিয়ে।অনেক লাইক, লাভ রিয়েক্ট, কমেন্টে বাহবা পেয়েছিলো ছেলেটা। যাকে আমার মতে সিম্প্যাথি নেওয়া এবং জনপ্রিয় হওয়ার ধান্দাই বলা হয়।
হাস্যকর তাই না! এই ছেলেটাও ওই চোরগুলোর মতোই নারী দিবসে কিছু সত্যিকারের ভালো মানুষের সাথে তাল মিলানোর জন্য পোস্ট করেছিলো যাতে বুঝায় তারাও নারীদের সম্মান করে। আসলে এরাই সিম্প্যাথি পাওয়ার জন্য পোস্ট করে। সব মানুষ না।
সত্যি ভাবতে কষ্ট লাগে এমন একটা সমাজে বাস করি যেখানে ছেলেদের দিকে আঙুল তোলা হয় প্রতিটা নারীর যন্ত্রণা, কষ্টের জন্য।তাদের উপর হওয়া ব্যবিচারের জন্য। কেন আমাদের দিকে আঙুল তুলবে ? আমরা কি এমন একটা সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে পারি না যেখানে আমাদের উপর আর আঙুল তোলার প্রয়োজন পড়বে না, আমাদের আর দোষারোপ করতে হবে না। পারি না আমরা নিজেদের পরিবর্তন করতে!!
এখনও হয়তো অনেকে বুঝতে পারছেন না বিষয়গুলো ; নিজের ভেতরে তর্কে মেতে আছেন।  বুঝবেন, ঠিকই বুঝবেন। যেদিন আপনার নিজের ঘাড়ে এসে বিষয়গুলো ভর করবে, সেদিন ঠিকই বুঝবেন। প্রত্যেকেই সংশোধন হওয়ার সুযোগ পায় জীবনে, দয়া করে সেই সুযোগ হারাবেন না।
.
®মাহাদী জিদান

মন্তব্যসমূহ